১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ফলে দেশে চরম রাজনৈতিক শূন্যতার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে দেখা দেয় নৈরাজ্যকর অবস্থা । মোশতাকের পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না । কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সেনাকর্মকর্তা ও সৈনিকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেই মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছেন । তাই এই সৈনিকদের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বঙ্গভবনে অবস্থান করে খুনিচক্র রাষ্ট্রক্ষমতায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এতে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড একেবারে ভেঙে পড়ে । উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের দাবির মুখেও নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেননি । কারণ ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সহায়তায় জিয়া সেনাপ্রধানের পদ লাভ করেছেন । সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া জিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না কিংবা ইচ্ছুক ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে জিয়ার নিষ্ক্রিয়তা সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়িয়ে দেয় । চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর মধ্যে নেতৃত্বের সংকট নিরসনে উদ্যোগী হন । তিনি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন । শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন সামরিক অভ্যুত্থান ছাড়া চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় । কর্নেল সাফায়াত জামিল এই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১লা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ বিশ্বস্ত কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হন। পাল্টা অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২রা নভেম্বর রাতে বঙ্গভবন থেকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান শুরু হয় । ৩রা নভেম্বর ভোররাতে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয় । খালেদ মোশাররফের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল নিয়ে খন্দকার মোশতাকের দেনদরবার চলতে থাকে। একপর্যায়ে জেনারেল ওসমানীর পরামর্শে ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের খুনিচক্র পরিবার-পরিজনসহ ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যায় । ৪ঠা নভেম্বর সকালে খালেদ মোশাররফ বর্বর, নৃশংস জেলহত্যার কথা জানতে পারেন ।
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর গভীর রাতে দেশত্যাগের পূর্বে ঘাতকের দল প্রেসিডেন্ট মোশতাকের অনুমতি নিয়ে বেআইনিভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে বন্দি অবস্থায় থাকা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে । মোশতাক নানা ভয়ভীতি দেখিয়েও জাতীয় চার নেতাকে তার সরকারের মন্ত্রিপদ গ্রহণে সম্মত করাতে পারেননি । যে কারণে খুনিচক্র কারাগারের ভেতরে এ রকম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটাল । এ হত্যাকাণ্ড ছিল '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সম্মিলিত ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার বাস্তবায়ন । উভয় হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ ধ্বংস, দেশকে নেতৃত্বশূন্য এবং পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা । ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড একই গোষ্ঠী সংঘটিত করে।
৪ঠা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ এক ঘোষণায় জানালেন যে, জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন । তিনি মোশতাকের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন তাকে পদোন্নতিসহ সেনাপ্রধান নিয়োগের জন্য । ক্ষমতার পালাবদলে মোশতাককে সম্মত করাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় । শেষ পর্যন্ত ৫ই নভেম্বর মাঝরাতে মোশতাক ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন । এই পরিস্থিতিতে খালেদ মোশাররফ ও অভ্যুত্থানকারী অফিসাররা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণে অনুরোধ করেন । ৬ই নভেম্বর বিচারপতি সায়েম বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মোশতাক ও জিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে এবং বঙ্গভবনকে খুনিচক্রের কবল থেকে মুক্ত করে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রক্ষমতায় তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন । সাহসী, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল । মুক্তিযুদ্ধে 'কে' ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে বহুবার সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন । কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন । ৩রা থেকে ৬ই নভেম্বর, মাত্র চার দিনের জন্য তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ৭ই নভেম্বর কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন খালেদ মোশাররফ। পরে খালেদ মোশাররফ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের হত্যা করা হয় ।